“Namami Barak...Celebrating the perennial spirit of Barak” থিম শুনা মাত্র মনটা খুশীতে ভরে গেলো। নদীর সন্তান আমরা, সারা বিশ্বকে নিয়ে আমাদের পালনকারিনী বরাকের উৎসব পালন করব, বিষয়টা সত্যি সত্যিই গর্ব এবং আনন্দের। Wetland Ecologist তো , তাই জলের প্রতি ভালোবাসাটা একটুক বেশীই, আর দিল্লীতে প্রবাসে আসছি বলেই হয়তো বরাকের জলে নীল যমুনার ছায়া খুঁজা মন, যমুনার জলেও খুঁজে ফেরে বরাকেরই মুখ। জাতীয় আন্তর্জাতিক সেমিনার, আলোচনা চক্র অথবা ইন্টারভিউ, আসাম বললেই লোকে জিজ্ঞেশ করে মাজুলি ? দীপর বিল ? কামাখ্যা। কারুর মুখে শুনিনি, নারায়ন ডহর গেছ? ভুবন? শনবিল , আহা চাতলা, কি সুন্দর। এইবার নমামীর দৌলতে হতো, ব্রহ্মপুত্রের মতো, বরাকও হবে পরিচিত। হয়তো চাতলা শনবিলও দীপরবিলের মতন প্রসিদ্ধি পাবে, হয়তো শক্তিসাধনার কেন্দ্রবিন্দু কামাখ্যা, শৈব তীর্থ উমানন্দের মতন, কাচাকান্তি, ভুবন, কপিলাশ্রমও ঠাই পাবে নিজের মর্যাদায়। তখনই বিশ্বের দরবারে স্থাপিত হবে আসামের পূর্ণ পরিচয়।
প্রাচীন কালে, মানুষ ছিল প্রকৃতির উপাসক, পাহাড়, নদী, গাছ পালা, অরন্যের পূজো করতো। বৈদিক মন্ত্রগুলোও তো নিবেদিত প্রকৃতিরই উদ্দেশ্যে। সরস্বতী নদীতীরে পঠন পাঠন সংস্কৃতির সূচনা হয়েছিল বলে , বিদ্যার দেবীর নামটাই হয়ে গেলো সরস্বতী। কিন্তু যেদিন প্রকৃতির দৈবী স্বরূপ হারিয়ে গেল মানুষের মন থেকে, সেদিন থেকেই প্রদূষণের বিষবাষ্পে ছেয়ে গেলো পৃথিবী। ত্রিভুবন তারিণী গঙ্গে আর ব্রজের সেই যমুনা আজ স্থানে স্থানে স্নানের ও অযোগ্য। ভাগ্যিস এখনও ব্রহ্মপুত্র , বরাক দুজনেই, এই অবস্থায় পৌঁছায়নি, হয়তো এই উৎসব নদী সংরক্ষণের বিষয়ে মানুষের ঘুম কিছুটা হলেও ভাঙিয়ে গেলে আমাদের ভবিষ্যৎ ততোটা অন্ধকার হবে না।
এই উৎসবের লোগো দেখার আগে উপত্যকার কজনেই বা জানতেন যে বরাকের বুকে বসবাস রয়েছে দুর্লভ প্রজাতীর নাদেয় ডলফিনদের। ফু মাছ বা হু মাছের এই দুর্লভ প্রজাতি যারা আমাদের গর্ব হতে পারতো, আমাদের চোখের সামনে থেকেই হারিয়ে গেলো প্রায়, আর সেই খবর জানতে পারলোই বা কয়জন? ডঃ পাউলেন সিনহা স্যার এর তত্বাবধানে সোমাভারা, আর ডঃ নিলেন্দু ধর স্যারের নেতৃত্বে আমরা , ডলফিন নিয়ে যে কাজ করে আসছি, ১৭ -১৮ বছর ধরে যে উপত্যকার গ্রাম শহরে কথা বলে আসছি, প্রশাসনের কাছে সময়ে সময়ে দাবী রেখে আসছি , সেই সব খবরই বা রাখল কে। পাউলেন স্যারের তো ডক্টরেটও ডলফিনদের নিয়ে। এই উৎসবের দৌলতেইতো আজ উপত্যকার প্রত্যেকটা শিশুও ডলফিন নিয়ে গর্বিত। আর সত্যি বলতে কি, তাদের বাসস্থান ফিরিয়ে দিলে, সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারলে তাদের ফিরে আসাও নিশ্চিত।
২০০৯-২০১৩ ডঃ সুস্মিতা গুপ্তা ম্যাড্যাম এর তত্বাবধানে চাতলার জলের পোকা মাকড় নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে খুঁজে পেয়েছিলাম এমন কিছু পোকাদের যাদের ব্যবহার করে ম্যালেরিয়া মশাদের নির্মূল করা যেতে পারে, ডিডিটির মতন বিষাক্ত পদার্থ ব্যবহার না করেই। এই বিষয়ে অনেক গুলো গবেষণা পত্র ছাপা হয়েছে , পরবর্তী গবেষণাও চলছে কিন্তু কাজে লাগানো হচ্ছে কই । ডঃ অভিক গুপ্ত স্যারের তত্বাবধানে ডঃ কুলেন্দ্র চন্দ্র দাস, কাজ করেছেন বরাকের কচ্ছপের উপরে, সেই কচ্ছপেরা আজ লুপ্ত প্রায়। আজও উপত্যকার বিভিন্ন স্থান থেকে বনরুই, হরিন, কচ্ছপের মাংস বিক্রির খবর আসে, সেই ক্রেতা বিক্রেতারাতো বরাকেই সন্তান।
যে কাজ গুলোর কথা উল্লেখ করলাম, সেগুলো উদাহরন মাত্র, এখানকার বিশিষ্ট কলেজ গুলোর এবং আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক- অধ্যাপিকারা, বরাকের জল হাওয়া মাটি পরিবেশ রক্ষার উদ্দেশ্য নিয়ে যে সব কাজ করাচ্ছেন , সেই গবেষণার ফল গুলো লাইব্রেরী, থেসিস আর গবেষণা পত্রে আবদ্ধ হয়ে রয়েছে । সেগুলোর খোঁজ নিয়ে নদীর এই উৎসব কে সমৃদ্ধ করে তোলার দায় আমার, আপনার, আমাদের। সূর্য চন্দ্র গ্রহ তারা নদীর মতন নমামি শব্দটা ও সংস্কৃত থেকেই নেয়া। তাই প্রনমামি শব্দ নয় কেন বলে দুঃখ করবেন না। কাপ প্লেটের বাঙলা শব্দ পেয়ালা পিরিচ, অথবা চেয়ারের বাঙলা কেদারা ইত্যাদি যে শব্দ যে শহীদদের এই মাটিতেও কেউ ব্যবহার করেন না সেই বিষয়ে আমি নিশ্চিত। তাই নমামি নিয়ে এতো ভাবনার কিছুই নেই।
কেউ ডাকলে ডাকবে, না ডাকলে নেই, নদী আমার- আপনার ,আমাদের নিজের, তাই উৎসবও আমাদের নিজের। এই উৎসবে যে শহর থেকে দূরে থাকব, সেটা কত যে কষ্টের তা দূরে যারা থাকে তারাই বুঝতে পারবে।
আমাদের বরাক উপত্যকার পাওনা দাবী গুলো আদায়ের জন্যে সংগ্রাম চলছে, চলবে আর চলতে থাকা খুবই জরুরী। তাই বলে এসব বিষয়কে এই উৎসবে ডেকে আনা কেন, সব নেইর মধ্যেই তো দুর্গোৎসবও হয়, দেয়ালীও, ইদ ও আসে, বড়দিনও। আর শুধু ধার্মিক উৎসব কেন গান্ধী মেলা, বইমেলা, বাণিজ্য মেলারা ও তো দুঃখ কষ্টের হাত ধরেই আসে আর খুশীর বার্তা বইয়ে দিয়ে যায়। ঠিক তেমনি নদীর উৎসবটা নদীরই থাক। ভুল-ভ্রান্তি, পাওয়া-নাপাওয়া, আশা পূরণ- আশা ভঙ্গ সব মিলিয়েই একটা উৎসব পরিপূর্ণতা লাভ করে, আসুন না, জাতি- ধর্ম-বর্ণ- রাজনীতি, নবীন-প্রবীন, সব ভুলে, মনে অল্প কষ্ট পেলে সেইকষ্টটাকে ভুলেই না হয়, জীবন দাত্রীর বন্দনায় সামিল হৈ।
ডঃ পিংকি পুরকায়স্থ ( চন্দ্রানী)
ডেপুটি ডিরেক্টার, ক্রেস
ম্যানেজিং এডিটার,ইজেনাস