 আমার
  শৈশবের প্রথম দিন,আলোছায়ার দ্বন্দে মাখামাখি সেই অবুঝ সকাল, মায়ের বুকের 
 কাছাকাছি মাথা রেখে পরিচয় ঘটেছিল তার সঙ্গে। সে আমার দাদু, দিদা,  
ঠাম্মা,দাভাই চারজনের অভাব পূর্ণ করেছিলো নিমেষে, না হলে হয়তো আমার শৈশব  
এতটা মধুর হয়ে উঠত না। একমাত্র সন্তান হিসেবে মা বাবার স্নেহ ভালোবাসা  
পেয়েছি পর্যাপ্ত পরিমাণ থেকে সহস্রগুন বেশী , সেই স্নেহ মমতা ঘেরা সকাল  
সন্ধ্যায়  সে ছিল  বিকেলের শেকল ভাঙা  বাঁশি , যে আমাকে পৌঁছে দিত কল্পনা আর বাস্তবের মাঝামাঝি এক অদ্ভুত দুনিয়ায়।  আমাদের বাড়িতে পিসীমনি কাজ করেছে বিশ বছর,  আমার জন্মের আগে আট বছর আর পরে বারো বছর, পরে  তার
  ছেলে দোকান খোলার পর, সে বিশ্রাম নেয়, কিন্তু তখনো প্রত্যেক বিকেলে ছুটে 
 আসতো আমার সাথে গল্প করতে, সন্ধ্যা অব্দি বসতো, মা চা বানাতেন, সন্ধ্যা  
ঘনিয়ে এলে, চা টা খেয়ে , বিদায় নিতো, আর আমরা দুজনই অপেক্ষায় রইতাম পরের  
বিকেলের। “বিকাল” শব্দটাকে সে উচ্চারণ করতো “বৈকাল” বলে, “চামচ” কে বলতো  
“চামিচ”। আর্থ-সামাজিক  ব্যাবধান কখনো কোনো বাধা সৃষ্টি করতে পারেনি আমাদের মনে,  কোনো দিন ও মনে হয় নি সে  আমাদের পরিবারের নয়।  আমি ডাকতাম পিসীমনি বলে কিন্তু  তার আর আমার সম্পর্কটা ওখানেই থেমে থাকেনি। সে আমার কাছে ছিল বিশ্বের জানালা, আমার  শিশুসুলভ অনেক চঞ্চলতার  একমাত্র সাক্ষী। লাল পেড়ে সাদা শাড়ী  পরিহিতা সেই পঞ্চাশোর্ধা  মহিলার কোলে বসেই শুনেছি কত গল্প, শুনেছি পূর্ববঙ্গেরই ( বর্তমান বাংলাদেশ)  কোনো এক জায়গায়, পদ্মার ধারে ছিল তার পিত্রালয়, তিন ভাইয়ের মৃত্যুর পর জন্ম হয়েছিল বলে, যমরাজ কে ঠকানোর আশায় মা-বাবা  নাম
  রেখেছিলেন নিরাশা , নিরাশা মণ্ডল। পিসীমনির কথার সুর ছিল টানা টানা,  
অনেকটা ঢাকা অঞ্চলের চলিত ভাষার মতন। পিসীমনির মুখে শুনেছি, তার বিয়ে  
হয়েছিল আড়াই বছর বয়েসে, পাত্র ছয় বছরের। থালায় বসিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল  
তাকে  ছাঁদনাতলায় ।  বিয়ের
  পর নাকি স্থির হয়, মেয়ে বড় হলে শ্বশুর বাড়ি নিয়ে যাওয়া হবে। পনেরো বছর  
বয়েসে দেশ স্বাধীন হয়, তখন সেও নিজের স্বামীর হাত ধরে ভারতে চলে আসে।  
পিসীমনির গর্ব ছিল তার স্বামীর ভালবাসা , স্বামীর কথা বলা মাত্র তার দুচোখ 
 উজ্জ্বল হয়ে উঠত, তার কাঠের একটা ছোট্ট বাক্সে বহুবার দেখেছি সযত্ন রক্ষিত
  এক কৌটো সিঁদুর, তার আন্তরিক বিশ্বাস ছিল এই সিঁদুরের ওপর, বলত ছেলেবেলায়  মন্ত্রপুতঃ
  এই সিঁদুরই নাকি পরতে দেওয়া হত তাকে, যাতে তার স্বামীর ভালোবাসায় ভাঁটা 
না  পড়ে, সেই বিশেষ সিঁদুরের একটু খানি সে যত্ন করে রেখে দিয়েছিল সেই  
বিশ্বাসেই । সে বলতো , তার দেশের বাড়ী ছিল ছবির মতন, মাটির ছোট্ট ঘর,  
বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা মাটির উঠোন, সূর্য ওঠা সকাল, আম কুড়ানো দুপুর,  
দিগন্তে ছুঁটে বেড়ানো বিকেল, ধুপ ধুনোর গন্ধ জড়ানো সন্ধ্যে, তক্ষকের ডাকে  
নিদ্রাহীন গা-ছমছম রাত, ভেলায় চড়ে তার ছুটে চলা মাছ ধরার উদ্দেশ্যে ।  
পিসীমনি আর মায়ের সম্পর্কটা ও ছিল মিষ্টি ।  পিসীমনির স্বামী মারা গেলে, আমার মা, বাবার চোখে ও জল দেখেছি। ও চোখে ভালো দেখতে  পেতোনা বলে, মা একটা চশমা আনিয়ে দিয়েছিলেন , খুব খুশী  হয়েছিল । প্রথম প্রথম  পরতে খুব ভালোবাসতো   কিন্তু পরে চশমাটাকে এতো বেশি ভালোবেসে ফেলেছিল যে  পরতেই চাইতো না, বলতো পুরনো হলে সৌন্দর্য কমে যাবে।  মা
  শীতের সময় ওর জন্যে সোয়েটার , কিনে আনতেন, যেটা প্রায় প্রতিবারই শীতের  
শেষে সে নিজের কোন গরীব নিকটাত্মীয়কে দিয়ে দিত , নিজের কথা চিন্তা না করে, 
 মা রাগ করলে ও হেসে ফেলতো ,  বলতো , সামনের বার আরেকটা তো পাবোই ।   পিসীমণির দুই ছেলে আমাকে খুব আদর করতো, বৌদি দের কাছে ও  পেয়েছি অনেক ভালবাসা।  ওরা আমাকে এখনো ডাকে “রিঙ্কন” নামে ।  দাদারা ঘুড়ি  বিক্রি করতো, আর সবচেয়ে সুন্দর ঘুড়িটা তুলে রাখত আমার জন্যে,  ঘুড়ি উড়ানোর চেষ্টায় ওদের বেশ কয়েকটা ঘুড়ি নষ্ট করেছি , আর ওরা হাসি মুখে মেনে নিয়েছে সব আবদার।  তবে একটা দুঃখ আজ ও রয়ে গেছে মনে, এতো চেষ্টার পর ও আমি ভালো করে ঘুড়ি ওড়ানো শিখতে পারিনি ।  পিসীমনির কোলে চড়ে বিকেলে বেড়াতে যাওয়া সব সময়ই ছিল আমার কাছে আনন্দের।  সে , পশু পাখি, প্রকৃতির সাথে বন্ধুত্বের  যে সম্পর্ক গড়ে  দিয়েছিল, সেটা কিছুটা হলে ও  আমার জীবনে  পরিবেশ বিজ্ঞানের  ভিত্তি স্থাপনে সহায়ক হয়েছে। পিসীমনি নাটাই ব্রত নামের কোনো এক ব্রত পালন করত শীতকালে, কুয়াশা ঘেরা  মাঘ মাসের হিমেল রাতে, কেরোসিনের কুপী হাতে  চলে
  আসতো আমাদের বাড়িতে, আমার হাতে ব্রতের প্রসাদ, চালের গুড়োর তৈরি এক বিশেষ
  ধরনের পিঠে তুলে দেওয়ায় জন্যে, সকাল পর্যন্ত সবুর করতে পারতো না। বাড়িতে 
 তখনো চালের তৈরি জিনিসে একটু খুঁতখুতে ভাব ছিল, কিন্তু সেটাই ছিল আমার  
প্রিয় খাবার। আজ আর সেই জিনিস টা খুঁজে পাই না।  তার গল্প বলার ভঙ্গি ছিল অসাধারন।  কতবার
  গল্পের ভেলায় চেপে পৌঁছে গেছি , সাত সাগরের দেশে , পঙ্খিরাজ ঘোড়ায় চড়ে  
তেপান্তরের মাঠে, ঘুমন্ত রাজকন্যার স্বপ্নের দেশে, দৈত্য দানার সঙ্গে  
সংঘর্ষে , পরীদের সাথে আকাশের খাঁজে খাঁজে লিখে গেছি শৈশবের ইতিহাস। মারা  
যাওয়ার কিছুদিন আগে সে আমাকে বলেছিল , বড় হয়ে ওকে একটা চাদর কিনে দিতে, যা ও
  আজীবন আগলে রাখবে, কাউকে দেবে না। কিন্তু আমি বড় হওয়ার আগেই সে চলে গেল। 
 পিসীর বাড়িতে ছিলাম, পিসতুতো দাদার বিয়েতে,চতুর্থ মঙ্গলের পরদিন ফিরে এসে 
 খবর পেলাম, আমার পিসীমনি হারিয়ে গেছে, হঠাৎ করে সে নাকি তার উঠোনে পড়ে  
গিয়েছিল মাথা ঘুরে, ঘটনার দুদিন পর শিলচর মেডিক্যাল কলেজে  তার মৃত্যু হয়। শেষ সময়টায় দেখা না করতে পারার  কষ্ট
  আমার কোনোদিনই ঘুচবে না, কিন্তু এর থেকেও বড় যে কষ্ট আজীবন বুকে ঘর বেঁধে
  থাকবে , সেটা হল আমি চাদর কিনে দেওয়ার সুযোগটাই পেলাম না। পিসীমনি তোমাকে
  খুঁজে পাবো সে ভাবনা ও আজ অলীক। বাস্তব জগত থেকে তুমি আজ সহস্র যোজন 
দূরে,  অনেকটা আকাশের তারার মতন তবু রয়েছ আমারই কাছাকাছি , মনের মণিকোঠায় ।
আমার
  শৈশবের প্রথম দিন,আলোছায়ার দ্বন্দে মাখামাখি সেই অবুঝ সকাল, মায়ের বুকের 
 কাছাকাছি মাথা রেখে পরিচয় ঘটেছিল তার সঙ্গে। সে আমার দাদু, দিদা,  
ঠাম্মা,দাভাই চারজনের অভাব পূর্ণ করেছিলো নিমেষে, না হলে হয়তো আমার শৈশব  
এতটা মধুর হয়ে উঠত না। একমাত্র সন্তান হিসেবে মা বাবার স্নেহ ভালোবাসা  
পেয়েছি পর্যাপ্ত পরিমাণ থেকে সহস্রগুন বেশী , সেই স্নেহ মমতা ঘেরা সকাল  
সন্ধ্যায়  সে ছিল  বিকেলের শেকল ভাঙা  বাঁশি , যে আমাকে পৌঁছে দিত কল্পনা আর বাস্তবের মাঝামাঝি এক অদ্ভুত দুনিয়ায়।  আমাদের বাড়িতে পিসীমনি কাজ করেছে বিশ বছর,  আমার জন্মের আগে আট বছর আর পরে বারো বছর, পরে  তার
  ছেলে দোকান খোলার পর, সে বিশ্রাম নেয়, কিন্তু তখনো প্রত্যেক বিকেলে ছুটে 
 আসতো আমার সাথে গল্প করতে, সন্ধ্যা অব্দি বসতো, মা চা বানাতেন, সন্ধ্যা  
ঘনিয়ে এলে, চা টা খেয়ে , বিদায় নিতো, আর আমরা দুজনই অপেক্ষায় রইতাম পরের  
বিকেলের। “বিকাল” শব্দটাকে সে উচ্চারণ করতো “বৈকাল” বলে, “চামচ” কে বলতো  
“চামিচ”। আর্থ-সামাজিক  ব্যাবধান কখনো কোনো বাধা সৃষ্টি করতে পারেনি আমাদের মনে,  কোনো দিন ও মনে হয় নি সে  আমাদের পরিবারের নয়।  আমি ডাকতাম পিসীমনি বলে কিন্তু  তার আর আমার সম্পর্কটা ওখানেই থেমে থাকেনি। সে আমার কাছে ছিল বিশ্বের জানালা, আমার  শিশুসুলভ অনেক চঞ্চলতার  একমাত্র সাক্ষী। লাল পেড়ে সাদা শাড়ী  পরিহিতা সেই পঞ্চাশোর্ধা  মহিলার কোলে বসেই শুনেছি কত গল্প, শুনেছি পূর্ববঙ্গেরই ( বর্তমান বাংলাদেশ)  কোনো এক জায়গায়, পদ্মার ধারে ছিল তার পিত্রালয়, তিন ভাইয়ের মৃত্যুর পর জন্ম হয়েছিল বলে, যমরাজ কে ঠকানোর আশায় মা-বাবা  নাম
  রেখেছিলেন নিরাশা , নিরাশা মণ্ডল। পিসীমনির কথার সুর ছিল টানা টানা,  
অনেকটা ঢাকা অঞ্চলের চলিত ভাষার মতন। পিসীমনির মুখে শুনেছি, তার বিয়ে  
হয়েছিল আড়াই বছর বয়েসে, পাত্র ছয় বছরের। থালায় বসিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল  
তাকে  ছাঁদনাতলায় ।  বিয়ের
  পর নাকি স্থির হয়, মেয়ে বড় হলে শ্বশুর বাড়ি নিয়ে যাওয়া হবে। পনেরো বছর  
বয়েসে দেশ স্বাধীন হয়, তখন সেও নিজের স্বামীর হাত ধরে ভারতে চলে আসে।  
পিসীমনির গর্ব ছিল তার স্বামীর ভালবাসা , স্বামীর কথা বলা মাত্র তার দুচোখ 
 উজ্জ্বল হয়ে উঠত, তার কাঠের একটা ছোট্ট বাক্সে বহুবার দেখেছি সযত্ন রক্ষিত
  এক কৌটো সিঁদুর, তার আন্তরিক বিশ্বাস ছিল এই সিঁদুরের ওপর, বলত ছেলেবেলায়  মন্ত্রপুতঃ
  এই সিঁদুরই নাকি পরতে দেওয়া হত তাকে, যাতে তার স্বামীর ভালোবাসায় ভাঁটা 
না  পড়ে, সেই বিশেষ সিঁদুরের একটু খানি সে যত্ন করে রেখে দিয়েছিল সেই  
বিশ্বাসেই । সে বলতো , তার দেশের বাড়ী ছিল ছবির মতন, মাটির ছোট্ট ঘর,  
বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা মাটির উঠোন, সূর্য ওঠা সকাল, আম কুড়ানো দুপুর,  
দিগন্তে ছুঁটে বেড়ানো বিকেল, ধুপ ধুনোর গন্ধ জড়ানো সন্ধ্যে, তক্ষকের ডাকে  
নিদ্রাহীন গা-ছমছম রাত, ভেলায় চড়ে তার ছুটে চলা মাছ ধরার উদ্দেশ্যে ।  
পিসীমনি আর মায়ের সম্পর্কটা ও ছিল মিষ্টি ।  পিসীমনির স্বামী মারা গেলে, আমার মা, বাবার চোখে ও জল দেখেছি। ও চোখে ভালো দেখতে  পেতোনা বলে, মা একটা চশমা আনিয়ে দিয়েছিলেন , খুব খুশী  হয়েছিল । প্রথম প্রথম  পরতে খুব ভালোবাসতো   কিন্তু পরে চশমাটাকে এতো বেশি ভালোবেসে ফেলেছিল যে  পরতেই চাইতো না, বলতো পুরনো হলে সৌন্দর্য কমে যাবে।  মা
  শীতের সময় ওর জন্যে সোয়েটার , কিনে আনতেন, যেটা প্রায় প্রতিবারই শীতের  
শেষে সে নিজের কোন গরীব নিকটাত্মীয়কে দিয়ে দিত , নিজের কথা চিন্তা না করে, 
 মা রাগ করলে ও হেসে ফেলতো ,  বলতো , সামনের বার আরেকটা তো পাবোই ।   পিসীমণির দুই ছেলে আমাকে খুব আদর করতো, বৌদি দের কাছে ও  পেয়েছি অনেক ভালবাসা।  ওরা আমাকে এখনো ডাকে “রিঙ্কন” নামে ।  দাদারা ঘুড়ি  বিক্রি করতো, আর সবচেয়ে সুন্দর ঘুড়িটা তুলে রাখত আমার জন্যে,  ঘুড়ি উড়ানোর চেষ্টায় ওদের বেশ কয়েকটা ঘুড়ি নষ্ট করেছি , আর ওরা হাসি মুখে মেনে নিয়েছে সব আবদার।  তবে একটা দুঃখ আজ ও রয়ে গেছে মনে, এতো চেষ্টার পর ও আমি ভালো করে ঘুড়ি ওড়ানো শিখতে পারিনি ।  পিসীমনির কোলে চড়ে বিকেলে বেড়াতে যাওয়া সব সময়ই ছিল আমার কাছে আনন্দের।  সে , পশু পাখি, প্রকৃতির সাথে বন্ধুত্বের  যে সম্পর্ক গড়ে  দিয়েছিল, সেটা কিছুটা হলে ও  আমার জীবনে  পরিবেশ বিজ্ঞানের  ভিত্তি স্থাপনে সহায়ক হয়েছে। পিসীমনি নাটাই ব্রত নামের কোনো এক ব্রত পালন করত শীতকালে, কুয়াশা ঘেরা  মাঘ মাসের হিমেল রাতে, কেরোসিনের কুপী হাতে  চলে
  আসতো আমাদের বাড়িতে, আমার হাতে ব্রতের প্রসাদ, চালের গুড়োর তৈরি এক বিশেষ
  ধরনের পিঠে তুলে দেওয়ায় জন্যে, সকাল পর্যন্ত সবুর করতে পারতো না। বাড়িতে 
 তখনো চালের তৈরি জিনিসে একটু খুঁতখুতে ভাব ছিল, কিন্তু সেটাই ছিল আমার  
প্রিয় খাবার। আজ আর সেই জিনিস টা খুঁজে পাই না।  তার গল্প বলার ভঙ্গি ছিল অসাধারন।  কতবার
  গল্পের ভেলায় চেপে পৌঁছে গেছি , সাত সাগরের দেশে , পঙ্খিরাজ ঘোড়ায় চড়ে  
তেপান্তরের মাঠে, ঘুমন্ত রাজকন্যার স্বপ্নের দেশে, দৈত্য দানার সঙ্গে  
সংঘর্ষে , পরীদের সাথে আকাশের খাঁজে খাঁজে লিখে গেছি শৈশবের ইতিহাস। মারা  
যাওয়ার কিছুদিন আগে সে আমাকে বলেছিল , বড় হয়ে ওকে একটা চাদর কিনে দিতে, যা ও
  আজীবন আগলে রাখবে, কাউকে দেবে না। কিন্তু আমি বড় হওয়ার আগেই সে চলে গেল। 
 পিসীর বাড়িতে ছিলাম, পিসতুতো দাদার বিয়েতে,চতুর্থ মঙ্গলের পরদিন ফিরে এসে 
 খবর পেলাম, আমার পিসীমনি হারিয়ে গেছে, হঠাৎ করে সে নাকি তার উঠোনে পড়ে  
গিয়েছিল মাথা ঘুরে, ঘটনার দুদিন পর শিলচর মেডিক্যাল কলেজে  তার মৃত্যু হয়। শেষ সময়টায় দেখা না করতে পারার  কষ্ট
  আমার কোনোদিনই ঘুচবে না, কিন্তু এর থেকেও বড় যে কষ্ট আজীবন বুকে ঘর বেঁধে
  থাকবে , সেটা হল আমি চাদর কিনে দেওয়ার সুযোগটাই পেলাম না। পিসীমনি তোমাকে
  খুঁজে পাবো সে ভাবনা ও আজ অলীক। বাস্তব জগত থেকে তুমি আজ সহস্র যোজন 
দূরে,  অনেকটা আকাশের তারার মতন তবু রয়েছ আমারই কাছাকাছি , মনের মণিকোঠায় ।
 Friday, August 3, 2012
মনের মণিকোঠা থেকে (১)
 আমার
  শৈশবের প্রথম দিন,আলোছায়ার দ্বন্দে মাখামাখি সেই অবুঝ সকাল, মায়ের বুকের 
 কাছাকাছি মাথা রেখে পরিচয় ঘটেছিল তার সঙ্গে। সে আমার দাদু, দিদা,  
ঠাম্মা,দাভাই চারজনের অভাব পূর্ণ করেছিলো নিমেষে, না হলে হয়তো আমার শৈশব  
এতটা মধুর হয়ে উঠত না। একমাত্র সন্তান হিসেবে মা বাবার স্নেহ ভালোবাসা  
পেয়েছি পর্যাপ্ত পরিমাণ থেকে সহস্রগুন বেশী , সেই স্নেহ মমতা ঘেরা সকাল  
সন্ধ্যায়  সে ছিল  বিকেলের শেকল ভাঙা  বাঁশি , যে আমাকে পৌঁছে দিত কল্পনা আর বাস্তবের মাঝামাঝি এক অদ্ভুত দুনিয়ায়।  আমাদের বাড়িতে পিসীমনি কাজ করেছে বিশ বছর,  আমার জন্মের আগে আট বছর আর পরে বারো বছর, পরে  তার
  ছেলে দোকান খোলার পর, সে বিশ্রাম নেয়, কিন্তু তখনো প্রত্যেক বিকেলে ছুটে 
 আসতো আমার সাথে গল্প করতে, সন্ধ্যা অব্দি বসতো, মা চা বানাতেন, সন্ধ্যা  
ঘনিয়ে এলে, চা টা খেয়ে , বিদায় নিতো, আর আমরা দুজনই অপেক্ষায় রইতাম পরের  
বিকেলের। “বিকাল” শব্দটাকে সে উচ্চারণ করতো “বৈকাল” বলে, “চামচ” কে বলতো  
“চামিচ”। আর্থ-সামাজিক  ব্যাবধান কখনো কোনো বাধা সৃষ্টি করতে পারেনি আমাদের মনে,  কোনো দিন ও মনে হয় নি সে  আমাদের পরিবারের নয়।  আমি ডাকতাম পিসীমনি বলে কিন্তু  তার আর আমার সম্পর্কটা ওখানেই থেমে থাকেনি। সে আমার কাছে ছিল বিশ্বের জানালা, আমার  শিশুসুলভ অনেক চঞ্চলতার  একমাত্র সাক্ষী। লাল পেড়ে সাদা শাড়ী  পরিহিতা সেই পঞ্চাশোর্ধা  মহিলার কোলে বসেই শুনেছি কত গল্প, শুনেছি পূর্ববঙ্গেরই ( বর্তমান বাংলাদেশ)  কোনো এক জায়গায়, পদ্মার ধারে ছিল তার পিত্রালয়, তিন ভাইয়ের মৃত্যুর পর জন্ম হয়েছিল বলে, যমরাজ কে ঠকানোর আশায় মা-বাবা  নাম
  রেখেছিলেন নিরাশা , নিরাশা মণ্ডল। পিসীমনির কথার সুর ছিল টানা টানা,  
অনেকটা ঢাকা অঞ্চলের চলিত ভাষার মতন। পিসীমনির মুখে শুনেছি, তার বিয়ে  
হয়েছিল আড়াই বছর বয়েসে, পাত্র ছয় বছরের। থালায় বসিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল  
তাকে  ছাঁদনাতলায় ।  বিয়ের
  পর নাকি স্থির হয়, মেয়ে বড় হলে শ্বশুর বাড়ি নিয়ে যাওয়া হবে। পনেরো বছর  
বয়েসে দেশ স্বাধীন হয়, তখন সেও নিজের স্বামীর হাত ধরে ভারতে চলে আসে।  
পিসীমনির গর্ব ছিল তার স্বামীর ভালবাসা , স্বামীর কথা বলা মাত্র তার দুচোখ 
 উজ্জ্বল হয়ে উঠত, তার কাঠের একটা ছোট্ট বাক্সে বহুবার দেখেছি সযত্ন রক্ষিত
  এক কৌটো সিঁদুর, তার আন্তরিক বিশ্বাস ছিল এই সিঁদুরের ওপর, বলত ছেলেবেলায়  মন্ত্রপুতঃ
  এই সিঁদুরই নাকি পরতে দেওয়া হত তাকে, যাতে তার স্বামীর ভালোবাসায় ভাঁটা 
না  পড়ে, সেই বিশেষ সিঁদুরের একটু খানি সে যত্ন করে রেখে দিয়েছিল সেই  
বিশ্বাসেই । সে বলতো , তার দেশের বাড়ী ছিল ছবির মতন, মাটির ছোট্ট ঘর,  
বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা মাটির উঠোন, সূর্য ওঠা সকাল, আম কুড়ানো দুপুর,  
দিগন্তে ছুঁটে বেড়ানো বিকেল, ধুপ ধুনোর গন্ধ জড়ানো সন্ধ্যে, তক্ষকের ডাকে  
নিদ্রাহীন গা-ছমছম রাত, ভেলায় চড়ে তার ছুটে চলা মাছ ধরার উদ্দেশ্যে ।  
পিসীমনি আর মায়ের সম্পর্কটা ও ছিল মিষ্টি ।  পিসীমনির স্বামী মারা গেলে, আমার মা, বাবার চোখে ও জল দেখেছি। ও চোখে ভালো দেখতে  পেতোনা বলে, মা একটা চশমা আনিয়ে দিয়েছিলেন , খুব খুশী  হয়েছিল । প্রথম প্রথম  পরতে খুব ভালোবাসতো   কিন্তু পরে চশমাটাকে এতো বেশি ভালোবেসে ফেলেছিল যে  পরতেই চাইতো না, বলতো পুরনো হলে সৌন্দর্য কমে যাবে।  মা
  শীতের সময় ওর জন্যে সোয়েটার , কিনে আনতেন, যেটা প্রায় প্রতিবারই শীতের  
শেষে সে নিজের কোন গরীব নিকটাত্মীয়কে দিয়ে দিত , নিজের কথা চিন্তা না করে, 
 মা রাগ করলে ও হেসে ফেলতো ,  বলতো , সামনের বার আরেকটা তো পাবোই ।   পিসীমণির দুই ছেলে আমাকে খুব আদর করতো, বৌদি দের কাছে ও  পেয়েছি অনেক ভালবাসা।  ওরা আমাকে এখনো ডাকে “রিঙ্কন” নামে ।  দাদারা ঘুড়ি  বিক্রি করতো, আর সবচেয়ে সুন্দর ঘুড়িটা তুলে রাখত আমার জন্যে,  ঘুড়ি উড়ানোর চেষ্টায় ওদের বেশ কয়েকটা ঘুড়ি নষ্ট করেছি , আর ওরা হাসি মুখে মেনে নিয়েছে সব আবদার।  তবে একটা দুঃখ আজ ও রয়ে গেছে মনে, এতো চেষ্টার পর ও আমি ভালো করে ঘুড়ি ওড়ানো শিখতে পারিনি ।  পিসীমনির কোলে চড়ে বিকেলে বেড়াতে যাওয়া সব সময়ই ছিল আমার কাছে আনন্দের।  সে , পশু পাখি, প্রকৃতির সাথে বন্ধুত্বের  যে সম্পর্ক গড়ে  দিয়েছিল, সেটা কিছুটা হলে ও  আমার জীবনে  পরিবেশ বিজ্ঞানের  ভিত্তি স্থাপনে সহায়ক হয়েছে। পিসীমনি নাটাই ব্রত নামের কোনো এক ব্রত পালন করত শীতকালে, কুয়াশা ঘেরা  মাঘ মাসের হিমেল রাতে, কেরোসিনের কুপী হাতে  চলে
  আসতো আমাদের বাড়িতে, আমার হাতে ব্রতের প্রসাদ, চালের গুড়োর তৈরি এক বিশেষ
  ধরনের পিঠে তুলে দেওয়ায় জন্যে, সকাল পর্যন্ত সবুর করতে পারতো না। বাড়িতে 
 তখনো চালের তৈরি জিনিসে একটু খুঁতখুতে ভাব ছিল, কিন্তু সেটাই ছিল আমার  
প্রিয় খাবার। আজ আর সেই জিনিস টা খুঁজে পাই না।  তার গল্প বলার ভঙ্গি ছিল অসাধারন।  কতবার
  গল্পের ভেলায় চেপে পৌঁছে গেছি , সাত সাগরের দেশে , পঙ্খিরাজ ঘোড়ায় চড়ে  
তেপান্তরের মাঠে, ঘুমন্ত রাজকন্যার স্বপ্নের দেশে, দৈত্য দানার সঙ্গে  
সংঘর্ষে , পরীদের সাথে আকাশের খাঁজে খাঁজে লিখে গেছি শৈশবের ইতিহাস। মারা  
যাওয়ার কিছুদিন আগে সে আমাকে বলেছিল , বড় হয়ে ওকে একটা চাদর কিনে দিতে, যা ও
  আজীবন আগলে রাখবে, কাউকে দেবে না। কিন্তু আমি বড় হওয়ার আগেই সে চলে গেল। 
 পিসীর বাড়িতে ছিলাম, পিসতুতো দাদার বিয়েতে,চতুর্থ মঙ্গলের পরদিন ফিরে এসে 
 খবর পেলাম, আমার পিসীমনি হারিয়ে গেছে, হঠাৎ করে সে নাকি তার উঠোনে পড়ে  
গিয়েছিল মাথা ঘুরে, ঘটনার দুদিন পর শিলচর মেডিক্যাল কলেজে  তার মৃত্যু হয়। শেষ সময়টায় দেখা না করতে পারার  কষ্ট
  আমার কোনোদিনই ঘুচবে না, কিন্তু এর থেকেও বড় যে কষ্ট আজীবন বুকে ঘর বেঁধে
  থাকবে , সেটা হল আমি চাদর কিনে দেওয়ার সুযোগটাই পেলাম না। পিসীমনি তোমাকে
  খুঁজে পাবো সে ভাবনা ও আজ অলীক। বাস্তব জগত থেকে তুমি আজ সহস্র যোজন 
দূরে,  অনেকটা আকাশের তারার মতন তবু রয়েছ আমারই কাছাকাছি , মনের মণিকোঠায় ।
আমার
  শৈশবের প্রথম দিন,আলোছায়ার দ্বন্দে মাখামাখি সেই অবুঝ সকাল, মায়ের বুকের 
 কাছাকাছি মাথা রেখে পরিচয় ঘটেছিল তার সঙ্গে। সে আমার দাদু, দিদা,  
ঠাম্মা,দাভাই চারজনের অভাব পূর্ণ করেছিলো নিমেষে, না হলে হয়তো আমার শৈশব  
এতটা মধুর হয়ে উঠত না। একমাত্র সন্তান হিসেবে মা বাবার স্নেহ ভালোবাসা  
পেয়েছি পর্যাপ্ত পরিমাণ থেকে সহস্রগুন বেশী , সেই স্নেহ মমতা ঘেরা সকাল  
সন্ধ্যায়  সে ছিল  বিকেলের শেকল ভাঙা  বাঁশি , যে আমাকে পৌঁছে দিত কল্পনা আর বাস্তবের মাঝামাঝি এক অদ্ভুত দুনিয়ায়।  আমাদের বাড়িতে পিসীমনি কাজ করেছে বিশ বছর,  আমার জন্মের আগে আট বছর আর পরে বারো বছর, পরে  তার
  ছেলে দোকান খোলার পর, সে বিশ্রাম নেয়, কিন্তু তখনো প্রত্যেক বিকেলে ছুটে 
 আসতো আমার সাথে গল্প করতে, সন্ধ্যা অব্দি বসতো, মা চা বানাতেন, সন্ধ্যা  
ঘনিয়ে এলে, চা টা খেয়ে , বিদায় নিতো, আর আমরা দুজনই অপেক্ষায় রইতাম পরের  
বিকেলের। “বিকাল” শব্দটাকে সে উচ্চারণ করতো “বৈকাল” বলে, “চামচ” কে বলতো  
“চামিচ”। আর্থ-সামাজিক  ব্যাবধান কখনো কোনো বাধা সৃষ্টি করতে পারেনি আমাদের মনে,  কোনো দিন ও মনে হয় নি সে  আমাদের পরিবারের নয়।  আমি ডাকতাম পিসীমনি বলে কিন্তু  তার আর আমার সম্পর্কটা ওখানেই থেমে থাকেনি। সে আমার কাছে ছিল বিশ্বের জানালা, আমার  শিশুসুলভ অনেক চঞ্চলতার  একমাত্র সাক্ষী। লাল পেড়ে সাদা শাড়ী  পরিহিতা সেই পঞ্চাশোর্ধা  মহিলার কোলে বসেই শুনেছি কত গল্প, শুনেছি পূর্ববঙ্গেরই ( বর্তমান বাংলাদেশ)  কোনো এক জায়গায়, পদ্মার ধারে ছিল তার পিত্রালয়, তিন ভাইয়ের মৃত্যুর পর জন্ম হয়েছিল বলে, যমরাজ কে ঠকানোর আশায় মা-বাবা  নাম
  রেখেছিলেন নিরাশা , নিরাশা মণ্ডল। পিসীমনির কথার সুর ছিল টানা টানা,  
অনেকটা ঢাকা অঞ্চলের চলিত ভাষার মতন। পিসীমনির মুখে শুনেছি, তার বিয়ে  
হয়েছিল আড়াই বছর বয়েসে, পাত্র ছয় বছরের। থালায় বসিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল  
তাকে  ছাঁদনাতলায় ।  বিয়ের
  পর নাকি স্থির হয়, মেয়ে বড় হলে শ্বশুর বাড়ি নিয়ে যাওয়া হবে। পনেরো বছর  
বয়েসে দেশ স্বাধীন হয়, তখন সেও নিজের স্বামীর হাত ধরে ভারতে চলে আসে।  
পিসীমনির গর্ব ছিল তার স্বামীর ভালবাসা , স্বামীর কথা বলা মাত্র তার দুচোখ 
 উজ্জ্বল হয়ে উঠত, তার কাঠের একটা ছোট্ট বাক্সে বহুবার দেখেছি সযত্ন রক্ষিত
  এক কৌটো সিঁদুর, তার আন্তরিক বিশ্বাস ছিল এই সিঁদুরের ওপর, বলত ছেলেবেলায়  মন্ত্রপুতঃ
  এই সিঁদুরই নাকি পরতে দেওয়া হত তাকে, যাতে তার স্বামীর ভালোবাসায় ভাঁটা 
না  পড়ে, সেই বিশেষ সিঁদুরের একটু খানি সে যত্ন করে রেখে দিয়েছিল সেই  
বিশ্বাসেই । সে বলতো , তার দেশের বাড়ী ছিল ছবির মতন, মাটির ছোট্ট ঘর,  
বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা মাটির উঠোন, সূর্য ওঠা সকাল, আম কুড়ানো দুপুর,  
দিগন্তে ছুঁটে বেড়ানো বিকেল, ধুপ ধুনোর গন্ধ জড়ানো সন্ধ্যে, তক্ষকের ডাকে  
নিদ্রাহীন গা-ছমছম রাত, ভেলায় চড়ে তার ছুটে চলা মাছ ধরার উদ্দেশ্যে ।  
পিসীমনি আর মায়ের সম্পর্কটা ও ছিল মিষ্টি ।  পিসীমনির স্বামী মারা গেলে, আমার মা, বাবার চোখে ও জল দেখেছি। ও চোখে ভালো দেখতে  পেতোনা বলে, মা একটা চশমা আনিয়ে দিয়েছিলেন , খুব খুশী  হয়েছিল । প্রথম প্রথম  পরতে খুব ভালোবাসতো   কিন্তু পরে চশমাটাকে এতো বেশি ভালোবেসে ফেলেছিল যে  পরতেই চাইতো না, বলতো পুরনো হলে সৌন্দর্য কমে যাবে।  মা
  শীতের সময় ওর জন্যে সোয়েটার , কিনে আনতেন, যেটা প্রায় প্রতিবারই শীতের  
শেষে সে নিজের কোন গরীব নিকটাত্মীয়কে দিয়ে দিত , নিজের কথা চিন্তা না করে, 
 মা রাগ করলে ও হেসে ফেলতো ,  বলতো , সামনের বার আরেকটা তো পাবোই ।   পিসীমণির দুই ছেলে আমাকে খুব আদর করতো, বৌদি দের কাছে ও  পেয়েছি অনেক ভালবাসা।  ওরা আমাকে এখনো ডাকে “রিঙ্কন” নামে ।  দাদারা ঘুড়ি  বিক্রি করতো, আর সবচেয়ে সুন্দর ঘুড়িটা তুলে রাখত আমার জন্যে,  ঘুড়ি উড়ানোর চেষ্টায় ওদের বেশ কয়েকটা ঘুড়ি নষ্ট করেছি , আর ওরা হাসি মুখে মেনে নিয়েছে সব আবদার।  তবে একটা দুঃখ আজ ও রয়ে গেছে মনে, এতো চেষ্টার পর ও আমি ভালো করে ঘুড়ি ওড়ানো শিখতে পারিনি ।  পিসীমনির কোলে চড়ে বিকেলে বেড়াতে যাওয়া সব সময়ই ছিল আমার কাছে আনন্দের।  সে , পশু পাখি, প্রকৃতির সাথে বন্ধুত্বের  যে সম্পর্ক গড়ে  দিয়েছিল, সেটা কিছুটা হলে ও  আমার জীবনে  পরিবেশ বিজ্ঞানের  ভিত্তি স্থাপনে সহায়ক হয়েছে। পিসীমনি নাটাই ব্রত নামের কোনো এক ব্রত পালন করত শীতকালে, কুয়াশা ঘেরা  মাঘ মাসের হিমেল রাতে, কেরোসিনের কুপী হাতে  চলে
  আসতো আমাদের বাড়িতে, আমার হাতে ব্রতের প্রসাদ, চালের গুড়োর তৈরি এক বিশেষ
  ধরনের পিঠে তুলে দেওয়ায় জন্যে, সকাল পর্যন্ত সবুর করতে পারতো না। বাড়িতে 
 তখনো চালের তৈরি জিনিসে একটু খুঁতখুতে ভাব ছিল, কিন্তু সেটাই ছিল আমার  
প্রিয় খাবার। আজ আর সেই জিনিস টা খুঁজে পাই না।  তার গল্প বলার ভঙ্গি ছিল অসাধারন।  কতবার
  গল্পের ভেলায় চেপে পৌঁছে গেছি , সাত সাগরের দেশে , পঙ্খিরাজ ঘোড়ায় চড়ে  
তেপান্তরের মাঠে, ঘুমন্ত রাজকন্যার স্বপ্নের দেশে, দৈত্য দানার সঙ্গে  
সংঘর্ষে , পরীদের সাথে আকাশের খাঁজে খাঁজে লিখে গেছি শৈশবের ইতিহাস। মারা  
যাওয়ার কিছুদিন আগে সে আমাকে বলেছিল , বড় হয়ে ওকে একটা চাদর কিনে দিতে, যা ও
  আজীবন আগলে রাখবে, কাউকে দেবে না। কিন্তু আমি বড় হওয়ার আগেই সে চলে গেল। 
 পিসীর বাড়িতে ছিলাম, পিসতুতো দাদার বিয়েতে,চতুর্থ মঙ্গলের পরদিন ফিরে এসে 
 খবর পেলাম, আমার পিসীমনি হারিয়ে গেছে, হঠাৎ করে সে নাকি তার উঠোনে পড়ে  
গিয়েছিল মাথা ঘুরে, ঘটনার দুদিন পর শিলচর মেডিক্যাল কলেজে  তার মৃত্যু হয়। শেষ সময়টায় দেখা না করতে পারার  কষ্ট
  আমার কোনোদিনই ঘুচবে না, কিন্তু এর থেকেও বড় যে কষ্ট আজীবন বুকে ঘর বেঁধে
  থাকবে , সেটা হল আমি চাদর কিনে দেওয়ার সুযোগটাই পেলাম না। পিসীমনি তোমাকে
  খুঁজে পাবো সে ভাবনা ও আজ অলীক। বাস্তব জগত থেকে তুমি আজ সহস্র যোজন 
দূরে,  অনেকটা আকাশের তারার মতন তবু রয়েছ আমারই কাছাকাছি , মনের মণিকোঠায় ।
 
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
 
No comments:
Post a Comment