Blogger Widgets

Friday, December 28, 2012

দামিনীর মৃত্যু অথবা আগুনের জন্ম

 
আমানত নামে ঘৃণাটা আর না ছড়ালে ও চলত,
কারুর আমানত নয় ,
খোলা আকাশে একমুঠো স্বস্তির নিঃশ্বাস,
অথবা মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকা,
দাবীটা কি বড্ড বেশী ছিল?
মাতৃগর্ভ থেকে সদর রাস্তা অথবা ফেসবুকের ভুবন,
বলির আয়োজনের বীভৎসতায় ,
সপ্তরথির উন্নাসিক চিৎকারে ,
বাঁচার আশায় শিশু অভিমন্যুর,
ব্যর্থ ডানা ঝাপটানো চক্রব্যূহের দোরগোড়ায় ।
সেই ভাবেই বেঁচে থাকাই যদি জীবন হয়,
তবে মা, নারী হীনতার অভিশাপ লাগুক এবার।
এমন পৃথিবী নিপাত যাক,
যেখানে নারীর গর্ভ থেকে জন্ম নেয়,
নারী মাংস খাদকেরা।

Tuesday, December 4, 2012

বেঁচে থাকার বর্ণমালা

 
রোদ রোদ বিকেল, এক বুক গভীর নিঃশ্বাস,
                                            দিগন্তের জানালায়, জ্বলুক টুপটাপ লন্ঠন চাঁদ।
আমি এঁকে যাব স্বপ্নের রামধনু টান ,
যতবার ও মুছে দিক না, সময়ের রুক্ষ ডাস্টার ।
আমার জলের খাতায় , কবিতার আঁশটে গন্ধ,
তোকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে শেখার গোপন আশ্বাস।
গীটারের ভাঙা তারে, জীবনের তান ,
ঝর-ঝর ঝরে পড়া মুহূর্তের ছিন্ন পাতায়।
সঞ্জীবনীর ম্যাজিক ছোঁয়ায়,
চোখ খুলুক এবার ঘুম-ঘুম রজনীগন্ধা ।
আবার বাঁচতে শেখা হোক না শুরু সেই ঠিকানায়, 
যেখানে রাত্রি শেষে সূর্য ওঠে।

Thursday, November 15, 2012

জীবনরেখা চাতলা - পিংকি পুরকায়স্থ চন্দ্রানী



কাজল কালো ডাগর চোখে, স্বপ্ন মধুর মেঘ আনমনা।
বৃষ্টির বিন্দুতে বিন্দুতে মোহনীয় ব্যগ্রতা।
হাওয়ার আলতো ছোঁয়ায় , ঢেউ খেলে যায় হৃদয় জুড়ে;
নবীনের হাতছানিতে, চিঠি লিখে যায় বউ কথা কও ।
হৃদয় তন্ত্রী জুড়ে মল্লারসুরে সবুজের আবাহন মন্ত্র।
নিস্তব্ধ বিকেলে সাধনা মগ্ন সাদা বক,
গভীর তন্ময়তায় হারিয়ে যায়, গহিন কালো জলের ঘনিষ্টতায়।
ডিঙ্গি নৌকো জুড়ে মাছ ধরার উদ্দীপনা।
ভাটিয়ালী সুরে, চাতলার বুকে সুখ দুঃখের ইতিহাস,
বৈঠার তালে তালে , মন কেমন করা অনুভুতির ব্যঞ্জনা।
নিজেকে হারিয়ে ফেলি, জল মাটির একান্ত আপনতার মাধুর্যে – পিংকি (চন্দ্রানী)
আসামের মোট জলাভূমির ১৪ শতাংশই বরাক উপত্যকায়। শিলচর শহরের অদূরে অবস্থিত এমনই একটি জলাভুমি হল চাতলা হাওয়র। হাওর শব্দের উৎপত্তি সম্পর্কে তেমন কিছু জানা না থাকলেও এইটুকু বলা যায় যে বাঙলা এবং আসামের বেশ কিছু জায়গায় গোলাকৃতি বিশালাকার জলাভূমিগুলোকে স্থানীয় ভাষায় হাওয়র বলা হয়ে থাকে। হাওরগুলো বর্ষায় জলে টুঁই টুম্বুর আবার শীতে খিট খিটে শুকনো ,  টুকরো টুকরো জলাশয়ের রূপ নেয় । বর্ষায় চাতলার বিস্তৃতি ১৭৫০ হেক্টরের চেয়ে ও বেশী হয় এবং গভীরতা ১০  মিটারকে ও ছাপিয়ে যায়।  নীল নয়না চাতলার সাথে গাঢ় সই সম্পর্ক বরাকের চঞ্চলা কিশোরী উপনদী ঘাঘরার ।   চাতলা তার আশেপাশের সমস্ত জলধারা কে নিজের মধ্যে সঞ্চিত করে রাখে এবং পরিমিত অনুপাতে ঘাঘরার স্রোতে নিজেকে রিক্ত করে জলের উচ্চতা বজায় রাখে। যেহেতু  প্রকৃতির সব কিছুতেই রয়েছে পরিমিতি অপরিমিতির হিসেব , তাই চাতলা কখনো সম্পূর্ণ ভাবে শুকিয়ে যায় না , শীতের নিস্তব্ধ দুপুরে রাজহাঁসের দল রাজকীয় ভঙ্গিমায় সাঁতার কেটে  অথবা  শীতের দীর্ঘ রাতগুলো নির্ঘুম চাঁদ  জলের আরশিতে নিজের চাঁদমুখ দেখে অবহেলায় কাটিয়ে দিতে পারে। ছবির মতন সাজানো চাতলা কে ঘিরে রয়েছে গ্রাম বরাকের নিজস্ব সংস্কৃতি , লোকাচার , জীবন যাত্রা। ঢেউয়ের তালে তালে ভেসে আসা ভাটিয়ালির সুর, নাম না জানা অচিন মাঝির গলায়  ব্যক্ত জগদীশ্বরের উদ্দেশ্যে আকুল প্রার্থনা ,

 বন্ধু,  অকূলে ভাসাইয়া আমায়,
কই রইল্যা রে..
নহর ও দরিয়ার বুকে রইল্যাম সাঁতরাইয়া ,
কি দুঃখ বুঝিবে বন্ধুরে কিনারে দাঁড়াইয়া ।
বন্ধু , কই রইল্যা রে...ও”
চাতলার কোলে মাথা উঁচু করে  দাঁড়িয়ে থাকা  অনেকগুলো গ্রাম আজও  ইলেকট্রিসিটির জাদু কাঠি থেকে   বঞ্চিত, বিশুদ্ধ পানীয় জল মরীচিকার মতো, রাস্তা ঘাটের অবস্থাও তথৈবচ,তবু এই দারিদ্র , চরম অবহেলা , সব কিছুর মধ্যেই এলাকার অধিবাসীরা যারা মূলতঃ মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের, তারা আগলে রেখেছেন নিজের একান্ত আপন অকপট আন্তরিক সুখ, তৃপ্তি ,আনন্দ কে।  হাজার রিক্ততা, প্রতিকুলতা ও বঞ্চনার  বর্ণহীনতা , আশার রঙ স্বপ্নের তুলি দিয়ে বর্ণময় করে তোলে তারা সাজিয়ে নেন আপন স্বপ্নের ভুবন।   তাই তো হাড়ভাঙা খাটুনির পর সন্ধ্যার আবছা আলোয়  মেতে উঠতে পারেন মনসা মঙ্গল , তিন নাথের সেবা , হরিনাম সংকীর্তনে। লোকগীতির সুরে সুরে যশোদার বাৎসল্য, গোপালের শিশু সুলভ চপলতা –আনন্দ-দুঃখ –অভিমান , রাধার অশ্রুকনা, হিমালয় জায়া মেনকার কন্যা উমার অদর্শনে  উদ্বিগ্নতা , কাছে পাওয়ার আনন্দ , নবমী রাত না পোহানোর আকুতি হয়ে উঠতে পারে তাদের আপন পরিবারের পল্প , চাওয়া পাওয়া নাপাওয়ার ব্যক্ত অব্যক্ত ইতিহাস।   
সাপের মতন এঁকে বেঁকে চলা রাস্তার দুপাশে , মাটিতে নিকানো ছন বাঁশের ঘর,  উঠোনের মধ্যমণি মমতা ঢালা তুলসি বেদী, বারান্দার কোনে দুপুরের পড়ন্ত রোদে ঘুম ঘুম চোখে কর্তব্যরত কুকুর, সদ্য চান করে ফিরে আসা হাঁসের দল,  পালকের যত্নে উন্মুখ পায়রার  গম্ভীর বাকবাকুম , বাঁশের বেড়ার উপর মেলে রাখা জাল, উঠোনের কোনে মাছ ধরার ডরি, চেপা, কোচা , দুপুরের রোদে মাছ শুকানোর কাজে  ব্যস্ত নববধূ ,  চাতলার  বুকে মাছ ধরায় তন্ময় সন্ন্যাসীর মতন দৃপ্ত  সুঠাম বলিস্টদেহী যুবকেরা, হিজল ছায়াবীথিতে গরু চরানো রাখাল বালকের দল, ছাগ শিশু কোলে ঝুঁটি বাঁধা কিশোরী, ঘাটে  জল নিতে আসা মেয়েদের  সুখ দুঃখের কথোপকথন , হাসির অনুরণন সব কিছুই যেন  প্রকৃতির মতন অকৃপণ, সৌম্য, শান্ত, বাহুল্য বর্জিত ।    
আমাদের স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয় , আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতায় পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপিকা ডঃ সুস্মিতা গুপ্তের তত্বাবধানে এবং বিশ্ববিদ্যালয় অনুদান আয়োগের (ইউজিসি) আর্থিক সাকুল্যে  চাতলার জলের গুণগত মান, উৎপাদন ক্ষমতা এবং মৎস্যজীবীদের আর্থ সামাজিক অবস্থান নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণা সম্পর্কিত প্রজেক্ট হাতে তোলে নেওয়া হয়।  তিন বছরের বৈজ্ঞানিক পরীক্ষানিরীক্ষার পর চাতলার যে ছবি আমাদের  সামনে উঠে এসেছে সেটা জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে আশার প্রদীপ। রিপোর্ট অনুযায়ী চাতলার জলের গুণগত মান মোটামোট ভালোই। কিছু কিছু ক্ষেত্রে  যদি ও জলে লোহার ( আয়রন)  পরিমান বেশী পাওয়া গেছে তা সত্বে ও  জলে অক্সিজেন , কার্বন ডাই অক্সাইড  থেকে শুরু করে অম্ল / ক্ষারকতা এবং  অন্যান্য তত্বগুলো মৎস্য উৎপাদনের উপযোগী পরিমাপ নির্দেশ করছে। তবে কোন কোন জায়গায় ধান খেত এবং সবজি খেত থেকে জলের স্রোতে ভেসে আসা  সার এবং বিভিন্ন ধরনের কীটনাশক বৃষ্টির পর পরই দেখিয়েছে মারন চিহ্ন , জন্ম দিয়েছে ভীতির। আমাদের চারপাশে যে সব পোকা মাকড় রয়েছে এরা সবাই  কিন্তু  অপকারী নয় , কিছু কিছু পোকা মাকড় রয়েছে যারা ফসল উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। রাসায়নিক কীটনাশকের প্রভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে পড়ে অপকারীদের সংগে উপকারীরা ও। চাতলার জল উৎপাদনক্ষম এবং  এই জল যাতে কীট নাশকের সংস্পর্শে বিষিয়ে না যায়, সেই দায়িত্ব আমাদেরই। আমাদের লোক সংস্কৃতি এবং পরম্পরাগত লোকধারায় থরে থরে সাজানো রয়েছে সব সমস্যার সমাধান। প্রাকৃতিক সার এবং কীট নাশে পারম্পরিক পদ্ধতির প্রয়োগই মুক্ত করতে পারে প্রকৃতিকে বিষের করাল গ্রাস থেকে।  মৎস্যজীবিদের মতে বর্তমানে চাতলায় মাছের সংখ্যা এবং প্রজাতি দুটোই তলানির দিকে । তা ছাড়া মৎস্যচাষের জন্যে প্রয়োজনীয় খরচপাতির অভাবেও মৎস্যজীবিরা উৎপাদনবৃদ্ধি করতে পারছেন না । এই ব্যাপারে যে  তথ্যগুলো রিপোর্টে উঠে এসেছে  তার অন্যতম একটি হল মাছ ধরার জন্যে  নির্বিচারে মশারী জালের ব্যবহার। মশারীজাল বংশবিস্তারযোগ্য বয়েসের আগেই কেড়ে নেয় মাছেদের জীবন । দ্বিতীয়তঃ যখন চাতলার অন্তর্গত ফিসারীগুলো জলে একাকার হয়ে যায় তখন চাতলা সম্পূর্ণ রূপে সার্বজনীন সম্পত্তি হয়ে পড়ে , আবার শীতকালে যখন জল কমে আসে তখন ছোট ছোট ফিসারীগুলো মৎস্যজীবিদের নিজস্ব পারিবারিক সম্পত্তির আওতায় এসে পড়ে। ব্যবস্থাটি নিঃসন্দেহে সুন্দর, কিন্তু এর সাথে যদি কোন কোপার্টিভ অর্থাৎ সমবায় গড়ে তুলতে পারতেন এলাকার মৎস্যজীবিরা সেই ক্ষেত্রে  উৎপাদন বৃদ্ধির জন্যে প্রয়োজনীয় টাকার পয়সার ব্যবস্থা, মশারীজাল নিষিদ্ধ করণ , ভালো চারা সংগ্রহ , উপযুক্ত মৎস্যখাদ্য শনাক্ত করন এবং  প্রয়োগ , উপযুক্ত বাজারের সংস্থান অনেকাংশে সহজ হয়ে উঠতো ঠিক যেমনটা সম্ভব হয়েছে বাংলাদেশে।  চাতলা আমাদের সম্পদ , গ্রাম বরাকের জীবনরেখা। একে রক্ষা করার দায়িত্ব আমার , আপনার, আমাদের সবার। আসুন আমারা জীবনীশক্তিতে উদ্বেল করে রাখি আমাদের প্রিয় চাতলাকে।  



Thursday, October 25, 2012

শিলচরের দুর্গাপূজো: পূজো পরিক্রমা 
প্রথম অংশ : 
 
 দ্বিতীয় অংশ:
তৃতীয় অংশ :
চতুর্থ অংশ :
 

Thursday, September 20, 2012

আমরা দুবোন



                                       
যদি, তুই-আমি দুবোন ,
হতে পারতাম দুটো জোনাকি!
আঁধার রাতে এক মুঠো আলো ছড়িয়ে দিতাম,
ওল বনের শেষ সীমানায়।
অথবা হতে পারতাম দুটো পাখী,
উড়ে যেতাম সুদুরের টানে।  
আমি যখন মেঘের আড়ালে লুকিয়ে পড়তাম ,
তুই খুঁজে বের করে নিতিস কড়া শাসনে ।
আমার ছোট্ট পাখায় রোদ লেগে যায় পাছে,
সেই ভয়ে ত্রস্ত তুই , বেঁধে নিতি আমায়,
তোর পালকের  স্নিগ্ধ ছায়ায়।
মধু লোভী আমরা দুবোন , 
যদি হতে পারতাম , দুটো মৌমাছি।
ফুলে-ফুলে গুন গুনিয়ে কেটে যেত দিন।
ভালোবাসার গানে তুই ভরিয়ে দিতিস আকাশ বাতাস,
ঠিক শৈশবের মতন, আমার গলায় স্পষ্ট হতো তোরই গানের সুর।
পাগলপারা হয়ে যদি  বয়ে যেতে পারতাম,
 হতে পারতাম কাল বৈশাখী ঝড়!
উড়িয়ে নিতাম পুরাতনের আবর্জনা।  
পৃথিবীর রন্ধ্রে রন্ধ্রে বেজে উঠত,
নবীনের শঙ্খধ্বনি ।   
তখন ও তুই ধরে রাখতিস আমার হাত,
বলতিস, দূরে যাসনে ওরে দস্যি মেয়ে।  
                              চিরচঞ্চল আমরা দু বোন, যদি হতে পারতাম বৃষ্টি ,
ঝমঝমিয়ে নেচে উঠতাম টিনের ছাদে।
শেষে দুটো ধারার মতো মিলে মিশে বয়ে যেতাম,
মরুভুমির বুক চিরে, সবুজের বন্দনাগানে।  

Friday, August 3, 2012

মনের মণিকোঠা থেকে (১)


মার শৈশবের প্রথম দিন,আলোছায়ার দ্বন্দে মাখামাখি সেই অবুঝ সকাল, মায়ের বুকের কাছাকাছি মাথা রেখে পরিচয় ঘটেছিল তার সঙ্গে। সে আমার দাদু, দিদা, ঠাম্মা,দাভাই চারজনের অভাব পূর্ণ করেছিলো নিমেষে, না হলে হয়তো আমার শৈশব এতটা মধুর হয়ে উঠত না। একমাত্র সন্তান হিসেবে মা বাবার স্নেহ ভালোবাসা পেয়েছি পর্যাপ্ত পরিমাণ থেকে সহস্রগুন বেশী , সেই স্নেহ মমতা ঘেরা সকাল সন্ধ্যায়  সে ছিল  বিকেলের শেকল ভাঙা  বাঁশি , যে আমাকে পৌঁছে দিত কল্পনা আর বাস্তবের মাঝামাঝি এক অদ্ভুত দুনিয়ায়।  আমাদের বাড়িতে পিসীমনি কাজ করেছে বিশ বছর,  আমার জন্মের আগে আট বছর আর পরে বারো বছর, পরে  তার ছেলে দোকান খোলার পর, সে বিশ্রাম নেয়, কিন্তু তখনো প্রত্যেক বিকেলে ছুটে আসতো আমার সাথে গল্প করতে, সন্ধ্যা অব্দি বসতো, মা চা বানাতেন, সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে, চা টা খেয়ে , বিদায় নিতো, আর আমরা দুজনই অপেক্ষায় রইতাম পরের বিকেলের। “বিকাল” শব্দটাকে সে উচ্চারণ করতো “বৈকাল” বলে, “চামচ” কে বলতো “চামিচ”। আর্থ-সামাজিক  ব্যাবধান কখনো কোনো বাধা সৃষ্টি করতে পারেনি আমাদের মনে,  কোনো দিন ও মনে হয় নি সে  আমাদের পরিবারের নয়।  আমি ডাকতাম পিসীমনি বলে কিন্তু  তার আর আমার সম্পর্কটা ওখানেই থেমে থাকেনি। সে আমার কাছে ছিল বিশ্বের জানালা, আমার  শিশুসুলভ অনেক চঞ্চলতার  একমাত্র সাক্ষী। লাল পেড়ে সাদা শাড়ী  পরিহিতা সেই পঞ্চাশোর্ধা  মহিলার কোলে বসেই শুনেছি কত গল্প, শুনেছি পূর্ববঙ্গেরই ( বর্তমান বাংলাদেশ)  কোনো এক জায়গায়, পদ্মার ধারে ছিল তার পিত্রালয়, তিন ভাইয়ের মৃত্যুর পর জন্ম হয়েছিল বলে, যমরাজ কে ঠকানোর আশায় মা-বাবা  নাম রেখেছিলেন নিরাশা , নিরাশা মণ্ডল। পিসীমনির কথার সুর ছিল টানা টানা, অনেকটা ঢাকা অঞ্চলের চলিত ভাষার মতন। পিসীমনির মুখে শুনেছি, তার বিয়ে হয়েছিল আড়াই বছর বয়েসে, পাত্র ছয় বছরের। থালায় বসিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তাকে  ছাঁদনাতলায় ।  বিয়ের পর নাকি স্থির হয়, মেয়ে বড় হলে শ্বশুর বাড়ি নিয়ে যাওয়া হবে। পনেরো বছর বয়েসে দেশ স্বাধীন হয়, তখন সেও নিজের স্বামীর হাত ধরে ভারতে চলে আসে। পিসীমনির গর্ব ছিল তার স্বামীর ভালবাসা , স্বামীর কথা বলা মাত্র তার দুচোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠত, তার কাঠের একটা ছোট্ট বাক্সে বহুবার দেখেছি সযত্ন রক্ষিত এক কৌটো সিঁদুর, তার আন্তরিক বিশ্বাস ছিল এই সিঁদুরের ওপর, বলত ছেলেবেলায়  মন্ত্রপুতঃ এই সিঁদুরই নাকি পরতে দেওয়া হত তাকে, যাতে তার স্বামীর ভালোবাসায় ভাঁটা না পড়ে, সেই বিশেষ সিঁদুরের একটু খানি সে যত্ন করে রেখে দিয়েছিল সেই বিশ্বাসেই । সে বলতো , তার দেশের বাড়ী ছিল ছবির মতন, মাটির ছোট্ট ঘর, বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা মাটির উঠোন, সূর্য ওঠা সকাল, আম কুড়ানো দুপুর, দিগন্তে ছুঁটে বেড়ানো বিকেল, ধুপ ধুনোর গন্ধ জড়ানো সন্ধ্যে, তক্ষকের ডাকে নিদ্রাহীন গা-ছমছম রাত, ভেলায় চড়ে তার ছুটে চলা মাছ ধরার উদ্দেশ্যে । পিসীমনি আর মায়ের সম্পর্কটা ও ছিল মিষ্টি ।  পিসীমনির স্বামী মারা গেলে, আমার মা, বাবার চোখে ও জল দেখেছি। ও চোখে ভালো দেখতে  পেতোনা বলে, মা একটা চশমা আনিয়ে দিয়েছিলেন , খুব খুশী  হয়েছিল । প্রথম প্রথম  পরতে খুব ভালোবাসতো   কিন্তু পরে চশমাটাকে এতো বেশি ভালোবেসে ফেলেছিল যে  পরতেই চাইতো না, বলতো পুরনো হলে সৌন্দর্য কমে যাবে।  মা শীতের সময় ওর জন্যে সোয়েটার , কিনে আনতেন, যেটা প্রায় প্রতিবারই শীতের শেষে সে নিজের কোন গরীব নিকটাত্মীয়কে দিয়ে দিত , নিজের কথা চিন্তা না করে, মা রাগ করলে ও হেসে ফেলতো ,  বলতো , সামনের বার আরেকটা তো পাবোই ।   পিসীমণির দুই ছেলে আমাকে খুব আদর করতো, বৌদি দের কাছে ও  পেয়েছি অনেক ভালবাসা।  ওরা আমাকে এখনো ডাকে “রিঙ্কন” নামে ।  দাদারা ঘুড়ি  বিক্রি করতো, আর সবচেয়ে সুন্দর ঘুড়িটা তুলে রাখত আমার জন্যে,  ঘুড়ি উড়ানোর চেষ্টায় ওদের বেশ কয়েকটা ঘুড়ি নষ্ট করেছি , আর ওরা হাসি মুখে মেনে নিয়েছে সব আবদার।  তবে একটা দুঃখ আজ ও রয়ে গেছে মনে, এতো চেষ্টার পর ও আমি ভালো করে ঘুড়ি ওড়ানো শিখতে পারিনি ।  পিসীমনির কোলে চড়ে বিকেলে বেড়াতে যাওয়া সব সময়ই ছিল আমার কাছে আনন্দের।  সে , পশু পাখি, প্রকৃতির সাথে বন্ধুত্বের  যে সম্পর্ক গড়ে  দিয়েছিল, সেটা কিছুটা হলে ও  আমার জীবনে  পরিবেশ বিজ্ঞানের  ভিত্তি স্থাপনে সহায়ক হয়েছে। পিসীমনি নাটাই ব্রত নামের কোনো এক ব্রত পালন করত শীতকালে, কুয়াশা ঘেরা  মাঘ মাসের হিমেল রাতে, কেরোসিনের কুপী হাতে  চলে আসতো আমাদের বাড়িতে, আমার হাতে ব্রতের প্রসাদ, চালের গুড়োর তৈরি এক বিশেষ ধরনের পিঠে তুলে দেওয়ায় জন্যে, সকাল পর্যন্ত সবুর করতে পারতো না। বাড়িতে তখনো চালের তৈরি জিনিসে একটু খুঁতখুতে ভাব ছিল, কিন্তু সেটাই ছিল আমার প্রিয় খাবার। আজ আর সেই জিনিস টা খুঁজে পাই না।  তার গল্প বলার ভঙ্গি ছিল অসাধারন।  কতবার গল্পের ভেলায় চেপে পৌঁছে গেছি , সাত সাগরের দেশে , পঙ্খিরাজ ঘোড়ায় চড়ে তেপান্তরের মাঠে, ঘুমন্ত রাজকন্যার স্বপ্নের দেশে, দৈত্য দানার সঙ্গে সংঘর্ষে , পরীদের সাথে আকাশের খাঁজে খাঁজে লিখে গেছি শৈশবের ইতিহাস। মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে সে আমাকে বলেছিল , বড় হয়ে ওকে একটা চাদর কিনে দিতে, যা ও আজীবন আগলে রাখবে, কাউকে দেবে না। কিন্তু আমি বড় হওয়ার আগেই সে চলে গেল। পিসীর বাড়িতে ছিলাম, পিসতুতো দাদার বিয়েতে,চতুর্থ মঙ্গলের পরদিন ফিরে এসে খবর পেলাম, আমার পিসীমনি হারিয়ে গেছে, হঠাৎ করে সে নাকি তার উঠোনে পড়ে গিয়েছিল মাথা ঘুরে, ঘটনার দুদিন পর শিলচর মেডিক্যাল কলেজে  তার মৃত্যু হয়। শেষ সময়টায় দেখা না করতে পারার  কষ্ট আমার কোনোদিনই ঘুচবে না, কিন্তু এর থেকেও বড় যে কষ্ট আজীবন বুকে ঘর বেঁধে থাকবে , সেটা হল আমি চাদর কিনে দেওয়ার সুযোগটাই পেলাম না। পিসীমনি তোমাকে খুঁজে পাবো সে ভাবনা ও আজ অলীক। বাস্তব জগত থেকে তুমি আজ সহস্র যোজন দূরে, অনেকটা আকাশের তারার মতন তবু রয়েছ আমারই কাছাকাছি , মনের মণিকোঠায় ।

Monday, June 18, 2012

মেঘদূত

একফোঁটা বৃষ্টির জল, আলতো ছোঁয়ায় মুগ্ধ চিবুকে।
জীবনের স্বাদ লেগে থাকে চাতকের ঠোঁটের কিনারায়।
চাঁদের টেবিলে মাথা রেখে, রাত জাগা গন্ধরাজ;
ঝরা পাতার শোকে জন্ম নেয় কবিতারা ।
আলোকবর্ষ দূরের কাহিনী,
আবর্তিত নটরাজের মালার স্পন্দনে।
অলকাপুরির শ্যাওলাময় দেওয়ালে , আবছা ছায়া;
জোনাকির আলোয় না বলা কাহিনী,
 হাল্কা শিহরন পিয়ালের বনে।
শিপ্রার ভিজে আঁচলে হিজলের মাখামাখি ,  
“আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে” কালিদাসের মেঘদূত,
ঝরে পড়ে মাছরাঙ্গার রঙিন পালকে।

Tuesday, June 12, 2012

ঝড়- পিংকি পুরকায়স্থ চন্দ্রানী

 তুমিই তো বলেছিলে , সাথে থাকবো সুখে দুঃখে,
সূর্যোদয়ের সূর্যমুখী , আর অমানিশার একমুঠো জোনাকি হয়ে।
তুমিই তো বলেছিলে, আকাশের বুকে লিখে যাব নাম ,
তোমার আমার,মেঘের সাজে।
অথবা বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ব,
সুন্দরের আবাহনে।
মনে পড়ে তোমার? আমার সবুজ আঁচল ভরে দিয়েছিলে,
কনক চাঁপা উপহারে।
অবেলায় গেয়েছিলে মল্লার গীতি।
কাটাকুটির ছলে, লিখে ছিলে নিজের নাম,
কাঠমল্লিকার বুকে।
যা প্রজাপতি হয়ে উড়ে গিয়েছিল,
দখিনের জানালায়।
একফোঁটা শিশির হয়ে লিখেছিল কবিতা,
চোখের পাতার আধফোটা কুঁড়িতে।
শতচ্ছিন্ন সেই প্রেমের কবিতা,রাখালিয়া বাঁশী,
ভেসে গেছে সেদিন, কাল বৈশাখী ঝড়ে।
রয়ে গেছে
 শুধু  সবুজের ইতিহাস,
দুটো উপড়ে যাওয়া বটগাছের নিষ্প্রাণ দেহ।

Thursday, May 17, 2012

ভোর কি আদৌ হবে????

চোখের জলে জন্ম তার, নাম সুরধনী,
যুগ যুগ ধরে বয়ে চলা , পাপের এন্টিসেপ্টিক হাতে।
না, পাপ তোমার কমেনি বৈকি বেড়েছে ,
শুষে নিয়ে রোগের ভার সেও আজ রুগ্ন।
অবসাদের কালিমায় অবশ অন্তর , গায়ে কালশিটে ,
সেও আজ কাঁদে সব হারানোর বেদনায়।
তারা, কুন্তি, দ্রৌপদীরা খুঁজে ফেরে আশ্রয়,
 
সতীত্বের মহাগাথার আনাচে কানাচে।
ভোর কি আদৌ হবে, প্রশ্ন কাঁঠাল পাখীর বুকে।

Saturday, January 28, 2012

অপার বাঙলার জন্যে

অপার বাঙলার জন্যে,  ছোট্ট একটি প্রয়াস,আমার তৈরি ছোট্ট একটি ভিডিও ," রেইনি ডে " গানটির সাথে।

Wednesday, January 25, 2012

ভাবনা


তুমি  নিজের রক্তে লিখে দিয়ে গিয়েছিলে,
একটি শব্দ "স্বাধীনতা ",
আমার খাতার পাতায়।
অর্থ বুঝতে অনেক দিন লেগেছিল ,
এখনও কতটুকুই বা বুঝতে পেরেছি?
প্রতি সকাল সন্ধ্যায় ,একা একা নিরালায় ভাবতে বসি , 
তোমার রক্তের বিনিময়ে,
নিয়ে আসা স্বাধীনতা কি আমার কাছে সুরক্ষিত?  
বড় বড় অট্টালিকার আড়ালে গড়ে উঠা,
ঘিঞ্জি বস্তির আবর্জনার স্তূপ থেকে ভেসে আসা,
লাওয়ারিস শিশুর অসহায় কান্না,
আমার চিন্তার প্রবাহ কে তছনছ করে দিয়ে যায়।
অনাহারে মৃত্যুর হিসেব  সংবাদপত্রের প্রথম পাতাটিকে ,
ভাগ করে নেয় কালো টাকার হিসেবের সাথে।
প্রজাতন্ত্রে প্রজার অধিকার  শীত ঘুমে,
রাজনীতির মারপ্যাছে নির্ধারিত স্থান-কাল-পাত্রের জীবন।
বুকের ভেতর পুঞ্জিভুত বেদনা ঘর বাঁধে । 
রাতের আঁধারে ভেসে উঠে তোমার অশ্রুসজল চোখ দুটো,
তুমি হয়ত ঘৃণা করছ আমার এই অপারগতাকে,
কিন্ত সত্যি বলছি, আমি এখনও হারিনি।। 
আঁধার গুহার ওপারেই নাকি আলোর বাসা,
আর আমি  সেই আলোরই সন্ধানে।।