Blogger Widgets

Wednesday, May 26, 2021

তোমাকে ছুঁতে পারিনিঃ একটি আলোচনা

 নৈরঞ্জনা তুমি গল্প শোনাও ,

সূর্যোদয়ের সেই প্রত্যুষের।
চেতনার ঢেউ আছড়ে পড়ুক,
ধূলোময় কাঁচের ঠুনকো দেয়ালে।
নৈরঞ্জনা ! তোমার কুলু-কুলু শব্দে,
হারিয়ে যাই, উরুবিল্বের পরিচয়হীন প্রান্তরে,
চেখে নেই সুজাতার পায়েস।
নৈরঞ্জনা , তোমার শ্রান্তবুকে;
ঢেউ জাগাক আবার, পূর্ণিমার চাঁদ।
তন্দ্রাচ্ছন্ন প্রহর, লুম্বিনির চোখে চোখ রেখে।।
নৈরঞ্জনা, তুমি কবিতা লিখ,
গোপার অশ্রুবিন্দুর শিশিরে।
বিষাদসিক্ত অক্ষরেরা স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতরো হয়ে উঠুক,
তিতিক্ষার স্নিগ্ধ উজ্জ্বলতায়।
নৈরঞ্জনা , তোমার কূলে-কূলে লালিত হোক,
শাক্যতরুন সিদ্ধার্থের স্বপ্ন।
নিষ্কাম বুদ্ধের মৈত্রীর মন্ত্র,
ছড়িয়ে পড়ুক শতচ্ছিন্ন প্রাণে।
নৈরঞ্জনা , ভেঙে ফেলো এবার মোহের প্রাচীর,
দৃষ্টিপথ ভেদ করে , মুক্তির ঘুড়ি উড়ে চলুক,
ব্রহ্মাণ্ডের শিরায় শিরায়।
নৈরঞ্জনা , মিলে মিশে যাও,
গঙ্গা-পদ্মা-ব্রহ্মপুত্র , বরাকের কালো জলে।
ব্যক্ত হোক আবার সেই সর্বত্যাগীর স্নিগ্ধ স্বরূপ,
মানবতা সঞ্জীবনীর আবাহনে।
***************************************************

নদীরা সত্যিই প্রার্থনা শোনে। সময়টা ২০১৪, এই কবিতাটি লিখেছিলাম। ১১মে, ২০১৪ বুদ্ধ পূর্ণিমা উপলক্ষে ছাপা হয়েছিল, শিলচর শহরের দৈনিক যুগশঙ্খ পত্রিকায়। অবশেষে নৈরঞ্জনা নদী নিজের মুখে শোনাল, বহুশ্রুত অথচ বহুপ্রতীক্ষিত এই কাহিনী। ধন্যবাদ লেখককে যিনি বইখানি উৎসর্গ করলেন আমাদের অতিপ্রিয় , আমাদের নিজস্ব নৈরঞ্জনা , মনু নদীকে।

ছোটবেলা বাবার আলমারি থেকে খুঁজে বার করা, বুদ্ধচরিত কখন জানি কি ভাবে আমার মননে ছাপ ফেলে গিয়েছিল নিজেরই অজান্তে। সেই থেকে বুদ্ধ আমার খুব কাছের মানুষ, হ্যাঁ মানুষই, রক্ত মাংসের মানুষ, যে দুঃখের সমুদ্র পার করার উপায় খুঁজতে বেরিয়েছিল সর্বস্ব ত্যাগ করে, একধরনের গবেষণা করেছিল নিজের উপর আর সফল ও হয়েছিল। আন্তমন্থনের অমৃত সবার মধ্যে বেটে দিয়েছিল নিঃস্বার্থে। আমার জীবনে মন খারাপ মানে কথনও “Light of Asia”, “What Buddha Taught” , কখনো “ত্রিপিটক পরিচিতি”, কখনো “জাতক” তো কখনো “Things when fall apart”. বুদ্ধ পূর্ণিমা চিরদিন আমাদের বাড়িতে মহোৎসবের দিন, কিন্তু সেখানে বুদ্ধ কোথাও ছিলেন না, বেশ বড় করে হতো সত্যনারায়নের পূজো। এই দিনটি আমার বাবা মায়ের বিবাহ বার্ষিকীও। এই পূজো, আনন্দোৎসবের মধ্যেও আমার মনের ভেতর একটা মানুষ খুঁজে বেড়াতো শান্ত স্থিমিত ধ্যানস্থ বুদ্ধকে, আর একটি মেয়ের সাথে আমি হয়ে উঠতাম একাত্ম। মেয়েটির উল্লেখ রয়েছে বুদ্ধ সাহিত্যে প্রধানতঃ একটিই দৃশ্যে তবু জানিনা কতবার নিজেকে মিলিয়ে নিয়েছি তার সাথে। প্রতি বুদ্ধ পূর্ণিমায় পায়েসান্ন রান্না করে, অর্পণ করেছি। সারাজীবন ধরে একটা ইচ্ছে, সুজাতাকে গভীর ভাবে জানার, নৈরঞ্জনা নদীর চোখে সিদ্ধার্থকে দেখার। শ্রদ্ধেয় লেখক সন্মাত্রানন্দ , যিনি আমাদের কাছে অতিপ্রিয় “মহারাজ” উনার “তোমাকে ছুঁতে পারিনি” বইটি হাতে পেয়েছিলাম একবছর আগে, পাওয়া মাত্র একদিনে শেষ করেছিলাম বইখানা, আসলেই উনার লেখা গুলো পড়তে পড়তে এভাবে ডুবে যাই যে সময়জ্ঞানই উড়ে যায় মানসপট থেকে। একবছর পর, জ্যোৎস্নাভাসা গতকাল রাতে, ঘুমন্ত বেলায়, মোবাইল আলোর নীচে আরেকবার পড়ে ফেলা, সিদ্ধার্থময় এই বইটি। বইটির বৈশিষ্ট হোল, এখানে কোনও দেবপুরুষ, মহাপুরুষ, অবতার বুদ্ধকে খুঁজে পাবেন না, পাবেন রক্ত মাংসের সিদ্ধার্থকে, তাঁর অনুসন্ধিৎসা, তাঁর সংগ্রামকে, তাঁর বুদ্ধ হয়ে ওঠার কঠিন পথটিকে। যতবারই পড়েছি, শব্দের নেশায় বুদ হয়ে গেছি, মনে হয়েছে আমিও হাঁটছি সেই সৌম্য শাক্য সন্ন্যাসীর পদাঙ্ক অনুসরণ করে, চেখে নিচ্ছি গুড়, কদলি, তক্র ও চিপিটক। দেখা হয়েছে মকখলি গোশাল, নিগন্থ নাথপুত্ত, সঞ্জয় বেলটঠিপুত্তের সাথেও। মার কে ও দেখতে পেলাম, দেখা হোল অঙ্গুলিমালের সাথে, আর যাকে খুঁজে পেলাম তার নাম কোথাও হয়তো খুঁজে পাবেন না, সে হোল উরুবিল্বের তরুণ কবি সৌদাস, সুজাতার প্রণয়ী এবং স্বামী। সৌদাসের চোখে সুজাতাকে, আর সুজাতার চোখে সৌদাসকে নতুন করে চিনতে পারা কত বড় যে প্রাপ্তি তা মনে হয় না, লেখককে বলে বুঝাতে পারবো। সৌদাস যখন উদাত্ত হয়ে ফিরে এলো, পরজন্মের স্মৃতি হারিয়ে তাকে চিনতেই পারলো না মল্লিকা, অথছ বুকে তার বিরহের বাঁশী। পরজন্মেও সেই, ময়ূখ ও হরিণী, সারনাথের এক পড়ন্ত বেলায় কতকিছু বলে গেল চোখে চোখে, কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারলো কই? যশোধরা গোপার বিরহক্লিষ্ট চেহারায় আভা হয়ে দেখাদিল পুষ্পলাবী কন্যার বহুযুগ প্রাচীন মুখআবয়ব , চোখে মুখে তার মেঘ-মানবের রেশ । মারের শেষ কথা গুলো কাঁপিয়ে গেল বুক, ঠিকতো , সে ছুঁতে পারেনি সিদ্ধার্থকে, কিন্তু আমরা কি কাজে লাগাতে পেরেছি বুদ্ধের সে কষ্ট লব্ধ জ্ঞানকে, আমরা কি পেরেছি মুক্ত হতে? না পারিনি ঠিক, তবু বুদ্ধ আজও আছেন আমাদের আশেপাশে আলোকবর্তিকা নিয়ে। মনে মনে যেন এখনো সোয়াস্তি ও পুন্না কে দেখতে পারছি, আগামীর প্রতিনিধি এরা, তাইতো সোয়াস্তির হাতে মিটমিটে প্রদীপ, পুন্নার মাথায় পায়েসের পাত্র, আর শিশুপুত্র কোলে সুজাতা কাছাকাছি, মনে মনে সুজাতার মতনই প্রার্থনা করছি, আর আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হচ্ছে “স্বস্তি”।


বুদ্ধ পূর্ণিমার শুভকামনা ...।।

No comments:

Post a Comment